অজ্ঞতার কুযুক্তি কী?
অজ্ঞতার কুযুক্তি বা কুতর্ক হলো এমন এক ধরণের ভুল যুক্তি, যেখানে বলা হয়—“আমরা কোনো কিছু জানি না, তাই আমার কথাটাই ঠিক।” অর্থাৎ, কোনো কিছু প্রমাণিত হয়নি বলে সেটা মিথ্যা নয়, কিংবা মিথ্যা প্রমাণ হয়নি বলে সেটা সত্য—এমন ভাবনাই এই কুযুক্তির মূল। এটা আসলে যুক্তির ঘাটতির ফল, যা মানুষকে ভুল পথে চালিত করতে পারে।
চলুন কিছু উদাহরণ দেখি:
১. “তুমি তো জানো না বিগ ব্যাং-এর আগে কী ছিল, তাই সেটা আমার ঈশ্বরই ঘটিয়েছেন।”
— এখানে বলা হচ্ছে, যেহেতু আমরা জানি না কীভাবে বিগ ব্যাং হলো, তাই নিশ্চয়ই ঈশ্বরই করেছেন। কিন্তু ‘জানি না’ মানেই তো কোনো কল্পনা বা বিশ্বাসকে সত্য ধরে নেওয়া যায় না।
২. “তুমি তো জানো না পিরামিড কীভাবে বানানো হয়েছে, তাই নিশ্চয়ই এলিয়েন বানিয়েছে।”
— এটা একটা নিছক কল্পনা। কারণ, পিরামিড বানানোর সব পদ্ধতি হয়তো আজও পরিষ্কার নয়, কিন্তু তাই বলে এলিয়েন বানিয়েছে ধরে নেওয়া যৌক্তিক না।
৩. “তুমি জানো না তোমার মাথায় কত চুল, তাই সেখানে ১৩,২৫৬টা চুল আছে।”
— একেবারে উদ্ভট যুক্তি! ‘জানি না’ মানে সঠিক সংখ্যাটা জানা নেই, কোনো মনগড়া সংখ্যা ঠিক ধরে নেওয়া নয়।
৪. “তুমি তো জানো না প্রশান্ত মহাসাগরে ঠিক কত লিটার পানি আছে, তাই ধরে নাও ৬ কোটি ৫৮ লাখ ১২৮ লিটার আছে।”
— এখানেও একই ভুল, কোনো অজানা বিষয়ে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যা চাপিয়ে দেওয়া কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়।
এই দাবিগুলো ভুল কেন?
কারণ, এগুলোর কোনোটাই সত্যি কোনো তথ্য বা প্রমাণের উপর দাঁড়িয়ে নেই। এখানে শুধু জানি না বলেই কেউ নিজের মতবাদ চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে। এটা যুক্তির বিরুদ্ধে যায়। কোনো কিছু না জানার মানে এই নয় যে যেকোনো কল্পনাকেই সত্য ধরে নিতে হবে।
এখন আরও কিছু উদাহরণ দেখা যাক:
ক) “বিজ্ঞান সবকিছু জানে না, তাই ঈশ্বর আছেন।”
খ) “বিগ ব্যাংয়ের আগে কী ছিল জানা যায় না, তাই ঈশ্বরই এর পেছনে আছেন।”
— এই দুটি কথাই আসলে অজ্ঞতার কুযুক্তি। বিজ্ঞান সবকিছু জানে না, এটা ঠিক। কিন্তু তাই বলে ঈশ্বর আছেন ধরে নেওয়া যুক্তিসঙ্গত না। তাহলে তো বলা যায়, “বিজ্ঞান জানে না বিগ ব্যাংয়ের আগে কী ছিল, তাই রামগরুরের ছানারা বিশ্ব সৃষ্টি করেছে!”—এ রকম অসংখ্য উদ্ভট দাবি করা যাবে।
বিজ্ঞান ধাপে ধাপে এগোয়। আগে যে বিষয়গুলো অজানা ছিল, সেগুলো এখন জানা যাচ্ছে। অজানা কিছু দেখলেই তাকে ঈশ্বরের ওপর ফেলে দিলে বিজ্ঞান থেমে যাবে।
আরও কিছু উদাহরণ:
- “তুমি জানো না থাইরয়েড ক্যান্সারের কারণ, তাই হুঁকো খাওয়াই কারণ।”
- “তুমি জানো না আটলান্টিক মহাসাগরে কত জল, তাই যিশুর জন্ম পিতা ছাড়া—এটা ঠিক।”
- “তুমি জানো না তোমার শরীরে কত চুল, তাহলে হজরত মোহাম্মদ (সঃ) ঘোড়ায় করে আকাশ পাড়ি দিয়েছেন—এটাও মানতে হবে।”
- “তুমি জানো না পাঁচ দিন পর কী হবে, তাই কিয়ামত হবে—এটাও মানো।”
এইসবই অজ্ঞতার কুতর্কের উদাহরণ। কেউ কিছু জানে না বলেই নিজের মতটাকে সত্য প্রমাণ করতে চায়। কিন্তু এভাবে তো তাকেও বলা যায়, “তুমি তো জানো না তোমার নিজের মাথায় কত চুল আছে, তাহলে তুমি জানলে কীভাবে কে বিশ্ব সৃষ্টি করেছে?”
বিজ্ঞানের কাজ কী?
বিজ্ঞানীরা তথ্য, প্রমাণ আর গবেষণার মাধ্যমে অজানা বিষয় জানার চেষ্টা করেন। বিগ ব্যাং হোক বা পিরামিড, সব কিছুর পেছনে তারা যুক্তি খোঁজেন। তারা বলেন, “আমরা জানি না”—তাতে কোনো দোষ নেই। বরং জানার চেষ্টা করাই হচ্ছে বুদ্ধির পরিচয়।
অজানা কোনো কিছু মানেই সেটা নিয়ে কল্পনা করা ঠিক না। সত্য জানার জন্য চেষ্টা করা, প্রমাণ খোঁজা—এটাই বিজ্ঞান ও যুক্তির পথ।
শেষ কথা
“আমি জানি না”—এই কথায় দুর্বলতা নেই, বরং এটা বুদ্ধিমানের কথা। জানি না মানেই এটা নয় যে মিথ্যা বা ভিত্তিহীন কোনো কল্পনা সত্যি হয়ে যাবে। বরং জানি না মানে হলো, জানার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।
অজ্ঞতার কুতর্ক মানে—যে কোনো ভিত্তিহীন দাবিকে সত্য প্রমাণ করার চেষ্টা, শুধু এই কারণে যে অন্য কেউ কিছু জানে না। এই ধরনের যুক্তি ভুল, আর সেটা কোনো সত্য প্রতিষ্ঠা করে না। আমাদের উচিত, প্রতিটা বিষয়ে যুক্তি আর প্রমাণের ভিত্তিতে ভাবা।
© নাফিস সাদিক শাতিল/ NAFIS SADIQUE SHATIL
আরো ব্লগপোস্ট পড়তে এখানে ক্লিক করুন
পড়ুন যুক্তিবিদ্যা বিষয়ক বইঃ Debating God With a Brain
পড়ুন ফিকশন বইঃ The Atheist Who Met God and Devil
পড়ুন ভ্রমণ কাহিনীঃ Adventure of Ryan and George