বিখ্যাত মিশরীয় নব্য প্লেটোবাদী দার্শনিক এবং গণিতজ্ঞ হাইপেশিয়াকে হত্যা করা হয় ৪১৫ খ্রিষ্টাব্দে। মাত্র ৪৫ বছর বয়সে। মৌলবাদের শিকার হয়ে তার মৃত্যুর বর্ণনা এভাবে পাওয়া যায়, “পিটার নামের এক আক্রোশী ব্যক্তি অনেকদিন ধরেই তক্কে তক্কে ছিলো, শেষমেষ সে হাইপেশিয়াকে কোন এক জায়গা হতে ফিরবার পথে কব্জা করে ফেলে। সে তার দলবল নিয়ে হাইপেশিয়াকে তার ঘোড়ার গাড়ী থেকে টেনে হিঁচড়ে কেসারিয়াম নামের একটি চার্চে নিয়ে যায়।
সেখানে তারা হাইপেশিয়ার কাপড়-চোপড় খুলে একেবারে নগ্ন করে ফেলে, তারপর ধারালো অস্ত্রের সাহায্যে তাঁর চামড়া চেঁছে ফেলে, তার শরীরের মাংস চিরে ফেলে, আর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত হাইপেশিয়ার উপর তাদের অকথ্য অত্যাচার চলতে থাকে। এখানেই শেষ নয়; মারা যাবার পর হাইপেশিয়ার মৃতদেহ টুকরো টুকরো করে সিনারন নামের একটি জায়গায় জড়ো করা হয় আর তারপর পুড়িয়ে তা ছাই করে দেয়া হয়।”
হাইপেশিয়ার মৃত্যুর আগে ৩৯১ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টান ধর্মান্ধরা ধ্বংস করে আলেকজান্দ্রিয়ার সারাপিউম জ্ঞানকেন্দ্র। ৫২৩ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট জাস্টিনিয়ান বন্ধ করে দেয় প্লেটোর একাডেমী।
৬৪২ খ্রিস্টাব্দে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়া হয় আলেকজান্দ্রিয়ার মহাগ্রন্থাগার, নষ্ট হয়ে যায় অনেক মূল্যবান গ্রীক বই ও নথিপত্র, তখন বহু পিছিয়ে পড়ে জ্ঞানচর্চা।
১৬০০ অব্দে পুড়িয়ে মারা হয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী জিয়োর্দানো ব্রুনোকে। তার বিরুদ্ধে অন্যতম অভিযোগ ছিল কোপার্নিকাসের সাথে সহমত জ্ঞাপন করা। অর্থাৎ পৃথিবী গোল, সূর্য এই মহাবিশ্বের কেন্দ্র নয় এবং এটি একটি নক্ষত্র ছাড়া আর কিছু নয়- এই ধারণা পোষণ করা। সাত বছর ধরে বিচারকাজ চলার পর ১৬০০ সালের ২০ জানুয়ারি পোপ ৮ম ক্লেমেন্ট ব্রুনোকে একজন ধর্মদ্রোহী বলে রায় দেন ও তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেন। রায় শুনে ব্রুনো বিচারকদের শাসিয়ে দিয়ে বলেন, “আপনারা হয়তো আমার সাথে হেরে যাবার ভয়ে আমার বিরুদ্ধে এই রায় দিয়েছেন। আমি এটি গ্রহণ করলাম।”
১৭ ফেব্রুয়ারি তাঁকে রোমের কেন্দ্রীয় বাজার Campo de’ Fiori এ নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁকে সবার সামনে খুঁটির সাথে বেঁধে পুড়িয়ে মারা হয়। তাঁর দেহভস্ম এরপর ছড়িয়ে দেয়া হয় টিবের নদীতে। ব্রুনো তাঁর মৃত্যুর পর প্রভূত সম্মান লাভ করেন। মহাশূন্য নিয়ে তাঁর মতবাদই ধীরে ধীরে সবার কাছে সঠিক বলে পরিগণিত হয়।
১৬৩৩ সালে বৃদ্ধ প্রায় অন্ধ গ্যালিলিউকে ফ্লোরেন্স থেকে প্রায় টেনে হিচড়ে রোমে নিয়ে যাওয়া হয়। অসুস্থ-বৃদ্ধ গ্যালিলিউকে হাটু গেড়ে সকলের সামনে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয়। তাকে বলতে বাধ্য করা হয়, বাইবেলই আসলে সঠিক, পৃথিবী স্থির অনড়-সৌরজগতের কেন্দ্রে। প্রাণ বাঁচাতে গ্যালিলিউ বললেন ঠিকই, কিন্তু আকাশের দিকে তাকিয়ে স্বগোক্তি করলেন, ‘তারপরও পৃথিবী কিন্তু ঠিকই ঘুরছে’।
ধর্মকে টিকিয়ে রাখতে চার্চের এই প্রয়াস সত্যকে চাপা রাখতে পারেনি। সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে অনেককেই মৃত্যুকে বরন করে নেয়া লেগেছে। এক সময় চার্চ ঠিকই তাদের ভুল স্বীকার করে নিল।
সপ্তদশ শতাব্দীর দিকে চার্চের দাপট অনেকটাই কমে এসেছিল। ১৮৫৮ সালে ওয়ালেস এবং ডারউইন যৌথভাবে বিবর্তনবাদ তত্ত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করার পর তাদেরও চার্চের রোষানলে পড়া লাগে। কিন্তু তখন চার্চের প্রভাব প্রতিপত্তি অনেকটাই কমে যাওয়ায় তারা বেশি সুবিধা করে উঠতে পারেননি।
আমাদের উপমহাদেশের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ১২০০ খ্রিষ্টাব্দে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করেন বখতিয়ার খলজি। ১৯২৯ সালে ‘রঙিলা রাসূল’ নামে বই প্রকাশিত হওয়ার পর হত্যা করা হয় বইটির প্রকাশক রাজপাল মালহোত্রাকে। ধর্মানুভুতিকে আঘাতের অজুহাতে এটাই উপমহাদেশের ইতিহাসে ঘটা প্রথম হত্যাকান্ড।
পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় ‘নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়’ ধ্বংস করেছিলেন ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী। সেখানে হাজার হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষুকে আগুনে পুড়িয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়। আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় প্রসিদ্ধ লাইব্রেরীটিতে। কথিত আছে লাইব্রেরীতে বইয়ের পরিমাণ এত বেশি ছিল যে সেগুলো পুড়ে ছাই হতে কয়েক মাস লেগেছিল। খিলজী শুধু নালন্দাকে পুড়িয়ে ছাই করেন নি, একই সাথে পুড়িয়ে ছাই করেছেন একটি জাতির সভ্যতা, ইতিহাস, প্রাচীন জ্ঞান বিজ্ঞানের অমূল্য বই যা থেকে আমরা জানতে পারতাম সে যুগের ভারত বর্ষের শিক্ষার অবকাঠামো, তত্কালীন সামাজিক-সাংষ্কৃতিক অবস্থা ও প্রাচীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্পর্কে।
এত এত খুন, ধ্বংসলীলায় বিজয়ের হাসি হেসেছিল কারা? কারা এতে আনন্দিত হয়েছিল? জ্ঞান বিজ্ঞান, শিল্পকলা, সাহিত্য চর্চা, নাটক-কবিতা-উপন্যাস-সঙ্গীত কাদের কাছে মূল্যহীন? কেন এই হিংস্রতা বর্বরতা?
যুগে যুগে ধর্মযাজক এবং উগ্রপন্থীরা তাদের ধর্মকে টিকিয়ে রাখতে সত্যকে ধামাচাপা দিয়েছে- ইতিহাসে এর উদাহরণ অনেক। বহু হত্যা নিধনযজ্ঞ চালিয়েছে। বহু গুরুত্বপূর্ণ নথি ধ্বংস করেছে তাদের ধর্মগ্রন্থের সাথে অসংগতির অভিযোগে। আমরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে কয়েকশ বছর পিছিয়ে পড়েছি। কিন্তু সত্যকে কোনভাবেই আটকে রাখা যায়নি। বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি সাধন হচ্ছে, ধর্মগুলোকে কোণঠাসা করে বিজ্ঞান এগিয়েই চলেছে।
নাফিস সাদিক শাতিল / NAFIS SADIQUE SHATIL
পড়ুন যুক্তিবিদ্যা বিষয়ক বইঃ Debating God With a Brain
পড়ুন ফিকশন বইঃ The Atheist Who Met God and Devil
পড়ুন ভ্রমণ কাহিনীঃ Adventure of Ryan and George
বিজ্ঞানীদের জীবনকাহিনী নিয়ে বইঃ From Apple to Algorithm
বইগুলোর প্রিন্টেড ভার্সন কিনুন আমাজন থেকে।