ইউরোপ তখন ঘোর অন্ধকারে। ধর্ম আর কুসংস্কারের মোটা চাদরে সব জড়ানো। চার্চ যা বলে, সেটাই শেষ কথা — কেউ কোথাও প্রশ্ন করার সাহস পায় না। ঠিক সেই সময়, ভিড়ের মাঝে নীরবে উঠে দাঁড়ালেন এক মানুষ। না, তিনি কোনো তলোয়ার হাতে বিপ্লবী ছিলেন না। কোনো উগ্র বক্তাও নন।
তিনি ছিলেন শান্ত মনের এক গবেষক — নিকোলাস কোপার্নিকাস।
১৪৭৩ সালের এক শীতল দিনে পোল্যান্ডের ছোট্ট শহর টরুনে জন্মেছিলেন তিনি। ছোটবেলাতেই বাবা-মাকে হারিয়ে ফেলেন। মামা লুকাস ওয়াটজেনরোড তাঁকে বুকে তুলে নিলেন। সেই মামাই পরে ওয়ার্মিয়ার বিশপ হন। ছোট্ট কোপার্নিকাসকে পাঠালেন ইউরোপের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে — ক্রাকোভ, বোলোনিয়া, পাডুয়া, ফেরারা — কোথায় যাননি তিনি!
পড়াশোনার তালিকা শুনলে মাথা ঘুরে যায় — আইন, চিকিৎসা, গণিত, ভাষা, জ্যোতির্বিজ্ঞান… কিন্তু এসবের মাঝেও কোপার্নিকাসের মন আটকে থাকত অন্য এক প্রশ্নে:
“আচ্ছা, যদি আমাদের শেখানো আকাশের গল্পটাই ভুল হয়?”
এই প্রশ্ন তখন করা মানেই মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া। তবু তিনি থামলেন না।
আকাশের নিচে একাকী গবেষণা
১৫১৩ থেকে ১৫১৬ সালের মাঝে, ফ্রমবর্কের ক্যাথেড্রালের এক টাওয়ারে বসে, প্রাচীন যন্ত্রপাতি দিয়ে তিনি আকাশ দেখতেন। টেলিস্কোপ তখনও আবিষ্কার হয়নি। তবুও তাঁর চোখ যেন ভেদ করত নক্ষত্রের রহস্য।
তিনি বুঝতে পারলেন, পটলেমিয়াসের সেই পুরনো মডেল — যেখানে পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্র — সেটা আসলে কেবল ধোঁকাবাজির এক সাজানো গল্প।
হয়তো, সত্যিটা হলো:
পৃথিবী নিজেই ঘুরছে।
১৫১৪ সালের আশেপাশে, কোপার্নিকাস গোপনে এক ক্ষুদ্র পাণ্ডুলিপি লেখেন — কমেন্টারিওলাস। সেখানে তিনি সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্বের কথা বলেন। এই পাণ্ডুলিপি কয়েকজন বিশ্বস্ত বন্ধুর হাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। কারণ তিনি জানতেন, সত্যি কথা বললেই তাঁর জীবন শেষ হয়ে যাবে।
তাই, নীরবেই প্রস্তুতি চলতে থাকলো।
সত্যের মহাকাব্য
অবশেষে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে, তাঁর ছাত্র রেটিকাসের সাহসে ভর করে কোপার্নিকাস রাজি হলেন তাঁর বৃহৎ কাজ প্রকাশ করতে:
De revolutionibus orbium coelestium — “স্বর্গীয় গোলকের আবর্তন সম্পর্কে।”
তিনি তাঁর বইটি পোপ পল III-কে উৎসর্গ করলেন, একটু আশ্রয় পাওয়ার আশায়। যেন বলছেন, “দেখুন মহারাজ, আমি কেবল গণিতের কথা বলছি, ধর্মের বিরুদ্ধে কিছু না।”
কিন্তু একবার বই ছাপা হয়ে গেলে, আর সে কথাকে থামানো যায়নি।
যখন চারপাশ ফুঁসে উঠলো
প্রথমে প্রোটেস্টান্টরা খেপে উঠল। মার্টিন লুথার তাঁকে প্রকাশ্যে বিদ্রূপ করলেন। মেলানকথন চাইলেন এই “ভ্রান্ত” শিক্ষা নিষিদ্ধ করতে। ক্যাথলিক চার্চও দেরিতে হলেও বুঝলো — এই বই শুধু একটা তত্ত্ব নয়, পুরো ধর্মীয় ভিত্তির উপর সরাসরি আঘাত।
এদিকে কোপার্নিকাস তখন মৃত্যুশয্যায়। ১৫৪৩ সালের ২৪শে মে, তিনি নিঃশব্দে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। বলা হয়, মৃত্যুর আগে শেষবারের মতো তাঁর বইয়ের একটি কপি হাতে নিয়ে দেখে গিয়েছিলেন — সেই বই, যা ভবিষ্যতের সব মহাবিপ্লবের বীজ হয়ে রইল।
নিষিদ্ধের তালিকায় নাম উঠলো
কোপার্নিকাস মারা যাবার অনেক বছর পর, চার্চ তাঁর বইটিকে নিষিদ্ধ করে দিল। কিন্তু তখন আর কিছু করার ছিল না। সত্য ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে।
পৃথিবী থামানো যায়নি। আর তার সঙ্গে সঙ্গে মানুষও আর পুরনো অন্ধকারে ফিরতে পারেনি।
জেগে উঠলো বিশ্ব
কোপার্নিকাসের লাগানো ছোট্ট স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠলো এক মহাকায় দাবানলে।
গ্যালিলিও টেলিস্কোপ নিয়ে প্রমাণ দিলেন পৃথিবী ঘুরছে।
কেপলার দেখালেন গ্রহপথ সরল বৃত্ত নয়, ইলিপ্স।
নিউটন খুঁজে পেলেন সেই শক্তি — মহাকর্ষ — যা এই পুরো মহাবিশ্বকে একসূত্রে বাঁধে।
বিজ্ঞান, যুক্তি আর প্রমাণ হয়ে উঠল নতুন পৃথিবীর বাতিঘর।
শেষ কথা
নিকোলাস কোপার্নিকাস পৃথিবীর কানে কানে একদিন বলেছিলেন:
“পৃথিবী নড়ে।”
চার্চ চিৎকার করলো। রাজারা জল্লাদ পাঠালো।
কিন্তু পৃথিবী থামলো না।
সত্য দেরি করে আসতে পারে, কিন্তু একবার এলে আর থামানো যায় না।
পৃথিবী এখনো নাচছে। তারা এখনো জ্বলছে। আর কোপার্নিকাসের সেই চুপিসারে বলা কথা —
আজও আমাদের হৃদয়ে বাজে।
© নাফিস সাদিক শাতিল/ NAFIS SADIQUE SHATIL
এই ক্যাটাগরির আরো ব্লগপোস্ট পড়তে এখানে ক্লিক করুন
পড়ুন যুক্তিবিদ্যা বিষয়ক বইঃ Debating God With a Brain
পড়ুন ফিকশন বইঃ The Atheist Who Met God and Devil
পড়ুন ভ্রমণ কাহিনীঃ Adventure of Ryan and George
বিজ্ঞানীদের জীবনকাহিনী নিয়ে বইঃ From Apple to Algorithm
বইগুলোর প্রিন্টেড ভার্সন কিনুন আমাজন থেকে।