রবিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫

Contact: shatilblog@gmail.com

প্রত্যেক প্রাণী কি জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি? : কোরআনে বৈজ্ঞানিক ভুল

কোরআনে একাধিক আয়াতে বলা হয়েছে, প্রতিটি বস্তু এবং প্রাণীকে আল্লাহ জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন।

সূরা ইয়াসিনের ৩৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ “পবিত্র মহান তিনি, যিনি উদ্ভিদ, মানুষ এবং তারা যাদেরকে জানেনা তাদের প্রত্যেককে সৃষ্টি করেছেন জোড়ায় জোড়ায়।”

সূরা যারিয়াতের ৪৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ “আমি প্রত্যেক বস্তু সৃষ্টি করেছি জোড়ায় জোড়ায়, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।”

এছাড়াও সূরা যুখরুফ এর ১২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ “তিনি সব কিছুকে জোড়া জোড়া সৃষ্টি করেছেন, আর তোমাদের জন্য নৌযান ও গবাদি পশু সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা আরোহণ কর।”

অনেক ইসলামিক বক্তারা আবার দাবী করেন যে, এসকল আয়াতে ‘জোড়ায় জোড়ায়’ বলতে নারী ও পুরুষ জোড়া বুঝানো হয়নি, বরং কেবল ‘দুটো’ বুঝানো হয়েছে। তাদের এমন ধারনা যে একেবারেই ভুল এবং কোরআনে ‘জোড়ায় জোড়ায়’ বলতে যে নারী পুরুষ জোড়া বা বিপরীত বস্তুদ্বয় বুঝানো হয়েছে যা একে অপরের পূরক তার প্রমাণ আমরা কোরআন থেকেই পাই।

সূরা নজম এর আয়াত ৪৫ এ বলা হয়েছেঃ “আর এই যে, তিনিই সৃষ্টি করেন জোড়া- পুরুষ আর নারী।”

সূরা আল কিয়ামাহ এর আয়াত ৩৯ এ বলা হয়েছেঃ “অতঃপর তিনি তা থেকে সৃষ্টি করেন জোড়ায় জোড়ায় পুরুষ ও নারী।”

কোরআনের ‘জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি’র দাবিটি তখনই ভুল প্রমাণিত হয় যখন আমরা প্রকৃতির দিকে তাকাই। প্রকৃতিতে এমন অসংখ্য জীব আছে যারা অযৌন প্রজনন পদ্ধতির মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি করে। এই পদ্ধতিতে একটি মাত্র জীব তার নিজের ক্লোন তৈরি করে, এবং এর জন্য কোনো পুরুষ বা নারী সঙ্গীর প্রয়োজন হয় না। উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়, হাইড্রা নামের ক্ষুদ্র জলজ প্রাণী নিজের শরীরের অংশ থেকে নতুন প্রাণী তৈরি করতে পারে, একে বলা হয় বাডিং। স্টারফিশ তার একটি বাহু থেকে সম্পূর্ণ নতুন প্রাণী গঠন করতে পারে। এককোষী প্রাণী অ্যামিবা এবং ইউগ্লিনা, যারা কোষ বিভাজনের মাধ্যমে নিজের মতো নতুন জীব তৈরি করে।

প্রত্যেক প্রাণী
নিউ মেক্সিকো হুইপটেইল

ছবিতে দেখতে পাচ্ছেন নিউ মেক্সিকো হুইপটেইল নামের একটি টিকটিকিকে। বিষ্ময়কর ব্যাপার হলো এটি সম্পূর্ণ অল-ফিমেল প্রজাতি — মানে, এখানে পুরুষ বলে কিছু নেই। অর্থাৎ এই টিকিটিকিদের সকলেই নারী। এই টিকটিকিরা পার্থেনোজেনেসিস নামের প্রক্রিয়ায় সন্তান জন্ম দেয়, যেখানে অনিষিক্ত ডিম থেকেই নতুন প্রাণীর জন্ম হয়। অর্থাৎ, এরা একাই মা হয়, আবার একাই নতুন প্রজন্ম সৃষ্টি করে।

এরকম আরও উদাহরণ আছে। এ্যামাজন মলি নামের এক ধরনের মাছ, যার বংশধারা শুধু নারীদের মধ্যেই চলে। তারা পুরুষ মাছের শুক্রাণু ব্যবহার করে শুধুমাত্র ডিমের বিকাশ শুরু করতে, কিন্তু সেই শুক্রাণুর জিন ডিমে প্রবেশ করে না। ফলে জন্ম নেওয়া সন্তান মায়ের ক্লোন হয় — জিনগতভাবে প্রায় হুবহু একই।

প্রত্যেক প্রাণী
কমোডো ড্রাগন

আরও চমকপ্রদ উদাহরণ হলো কমোডো ড্রাগন। বিশ্বের বৃহত্তম গুইসাপ। গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো পুরুষ ছাড়াই একটি কমোডো মেয়ে একাই ডিম পেড়ে সেখান থেকে নতুন বাচ্চা জন্ম দিতে পারে। এমনকি কিছু হাঙর প্রজাতিতেও একই ঘটনা দেখা গেছে। ২০০৭ সালে একটি একক মহিলা হ্যামারহেড শার্ক কোনো পুরুষ ছাড়াই সন্তান জন্ম দিয়েছিল — DNA টেস্টে পুরুষের কোনো জিন পাওয়া যায়নি।

এভাবে দেখা যায়, প্রকৃতি অনেক ক্ষেত্রেই একক প্রজনন সম্ভব করেছে। অর্থাৎ, “জোড়া” ধারণা এখানে একেবারেই প্রযোজ্য নয়। এখানে শুধু নারীই রয়েছে — কিন্তু জীবন থেমে নেই। কিছু অযৌন প্রাণীর উদাহরণ আরও বিস্ময়কর। যেমন ব্রাহ্মিণি ব্লাইন্ড স্নেক — একটি খুবই ছোট আকৃতির সাপ, যেটির এখন পর্যন্ত কোনো পুরুষ সদস্যের অস্তিত্বই পাওয়া যায়নি।

প্রত্যেক প্রাণী
ব্রাহ্মিণি ব্লাইন্ড স্নেক

বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এই সাপ ছড়িয়ে আছে, এবং প্রতিটি সদস্যই নারী। প্রাণীজগতে এমন অজস্র উদাহরণ রয়েছে। ছবিতে দেখতে পাচ্ছেন ট্রায়ারিস স্টেনাস্পিস নামক মাকড়সাকে।

ট্রায়ারিস স্টেনাস্পিস

যার এখন পর্যন্ত কোনো পুরুষ মাকড়সা বিজ্ঞানীরা খুঁজে পাননি। এই মাকড়সাগুলি নিজেরাই নিজের ক্লোন তৈরি করে।

মানুষের ক্ষেত্রেও “জোড়ায় জোড়ায়” ধারণাটি সবসময় খাটে না। জীববিজ্ঞানে আমরা জানি, মানুষের লিঙ্গ শুধু পুরুষ আর নারী—এই দুই ভাগে সীমাবদ্ধ নয়। প্রকৃতিতে রয়েছে ইন্টারসেক্স ব্যক্তিরা—যাদের শরীরে পুরুষ ও নারীর জৈব বৈশিষ্ট্য একসঙ্গে থাকতে পারে। অর্থাৎ, তাদের জেনেটিক বা হরমোনাল গঠন প্রচলিত “পুরুষ” বা “নারী” শ্রেণির মধ্যে পড়ে না। জন্ম থেকেই তারা এই জৈবিক বৈচিত্র্যের অংশ।

এছাড়া আরও আছে এ্যাসেক্সুয়াল মানুষ—যারা কারো প্রতি যৌন আকর্ষণই অনুভব করেন না। তারা না পুরুষের প্রতি, না নারীর প্রতি যৌন আগ্রহ রাখেন। এর মানে এই নয় যে তাদের শরীরে কোনো ত্রুটি আছে, বরং তাদের মস্তিষ্কের যৌন প্রতিক্রিয়া ভিন্নভাবে কাজ করে। আধুনিক মনোবিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞান উভয়েই একে মানব যৌনতার স্বাভাবিক বৈচিত্র্য বলে মানে।

এভাবেই দেখা যায়, মানুষ নামের প্রাণীর ভেতরেও প্রকৃতি কঠোর “জোড়ার” সীমায় বাঁধা নয়। বরং প্রকৃতি তার সৃষ্টিতে রেখেছে এক অসীম বৈচিত্র্য—যেখানে কেউ একা থেকেও পূর্ণ, কেউ পুরুষ-নারীর মাঝামাঝি, আবার কেউ যৌনতা ছাড়াই পরিপূর্ণ মানুষ। তাহলে প্রশ্ন আসে—যদি সত্যিই “প্রতিটি বস্তু ও প্রাণী জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি” হয়ে থাকে, তবে এই লক্ষ লক্ষ মানুষ, যারা কোনো জোড়ার অংশ নয়, তারা কোথা থেকে এলো?

এবার আসি উদ্ভিদজগতে। উদ্ভিদ জগতে বিষয়টি আরও ব্যাপক। অনেক গাছ নিজেই নিজেকে পরাগায়িত করে, যাকে বলে স্ব-পরাগায়ন। যেমন — সরিষা, ধুতুরা, শিম, টমেটো, সন্ধ্যামালতী। এসব গাছের আলাদা পুরুষ বা স্ত্রী গাছের প্রয়োজন হয় না, কারণ একই ফুলের ভেতরেই দুই অঙ্গ থাকে। আবার অনেক ছত্রাক আছে যাদের লিঙ্গ ২৮ হাজারেরও বেশি প্রকার — যেমন সিজোফিলাম কমিউন নামের ছত্রাক, যা প্রায় পুরো পৃথিবীজুড়েই পাওয়া যায়।

ভাবুন একটি প্রজাতির ২৮ হাজারের বেশি লিঙ্গ আছে। পৃথিবীর এতো এতো প্রাণীর শুধুমাত্র স্ত্রী লিঙ্গের প্রাণীরাই নিজেরাই সন্তান উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট। কোন কোন প্রানীর তো পুরুষ প্রজাতিই নেই। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে — এই বৈচিত্র্যময় প্রাণিজগতের তথ্য কি কোরানের লেখক জানতেন না? পৃথিবীর এই বৈচিত্র্যময় প্রাণীজগৎ সম্পর্কে কোরানের লেখকের কোন ধারণা ছিলোনা? ‘জোড়ায় জোড়ায় প্রানী সৃষ্টি’র মতো একটি শিশুসুলভ ভুল কিভাবে করলেন?

এধরণের অসংখ্য বৈজ্ঞানিক ভুলে ভরা কোরানের এসব ভুল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার পরও কিছু অন্ধবিশ্বাসী এসে ত্যানাবাজী শুরু করতে পারে। তারা বলতে পারে এই আয়াতে জোড়া বলতে জোড়া বোঝায়নি, আগের আয়াত পরের আয়াত পড়তে হবে, প্রেক্ষাপট জানতে হবে, এই আয়াতের অনুবাদ ভুল, এই নদীনালা গাছপালা লাউ পটল দেখলেই এই আয়াতের অর্থ বোঝা যায়, আরবিতে একই শব্দের অনেক রকম অর্থ থাকতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি। যারা এই ধরণের উদ্ভট দাবী নিয়ে আসবেন তাদের জন্য তাফিসিরে জালালাইন এবং তাফসিরে ইবনে কাসির থেকে এই আয়াতের ব্যাখ্যা জেনে নিই।

প্রথমেই তাফসীরে জালালাইন থেকে পড়িঃ

সুতরাং তাফসিরে জালালাইন থেকে এটা পরিষ্কার যে এই আয়াতে জোড়ায় জোড়ায় বলতে নারী ও পুরুষকেই বোঝানো হয়েছে। বোঝানো হয়েছে মানবজাতির ভেতর নারী পুরুষ সৃষ্টি করা হয়েছে যেন তারা পরস্পরের প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব করে এবং সন্তান দান করে। শুধু মানবজাতি নয় প্রতিটি প্রাণীর ভেতরেই নারী পুরুষ সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ যেন তারা নিজেদের ভেতর আকর্ষণ অনুভব করে এবং তাদের প্রজন্ম বৃদ্ধি করতে পারে।

একই আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরে ইবনে কাসিরে বলা হয়েছেঃ

সুতরাং তাফসিরগুলো থেকেও স্পষ্ট যে এই আয়াতে জোড়ায় জোড়ায় বলতে নারী ও পুরুষকেই বোঝানো হয়েছে।

আবার অনেক আধুনিক ইসলামিক ধর্মপ্রচারক এই আয়াতকে বিজ্ঞানের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করেন। তারা বলেন, এটি ম্যাটার ও অ্যান্টিম্যাটারের মতো বিপরীত বস্তুকে নির্দেশ করে, যা সপ্তম শতাব্দীর একজন মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না। তাই এটি নাকি কোরআনের অলৌকিকত্ব প্রমাণ করে। তাদের এই দাবীটিও মানুষকে বোকা বানানোর জন্য এক চরম নির্লজ্জ মিথ্যচার। প্রতারণার মাধ্যমে মানুষকে বিভ্রান্ত করার একটি চরম উদাহরণ। প্রাচীন চীন, গ্রীস এমনকি বৈদিক সভ্যতাতেও “দ্বৈত নীতি”র ধারণা প্রচলিত ছিল কোরআনের হাজার বছর আগে থেকেই।

কোরআনের বহু হাজার বছর আগেই প্রাচীন চীনে প্রচলিত ছিলো “ইন-ইয়াং” তত্ত্ব। যেখানে বলা হয়, বিশ্বজগৎ দুই বিপরীত কিন্তু পরিপূরক শক্তির মিশ্রণে গঠিত। এই নীতি খ্রিষ্টপূর্ব অন্তত ৪০০ বছর আগেই প্রচলিত ছিল, এবং সাং রাজবংশের সময় ব্রোঞ্জের পাত্রে ইন-ইয়াং চিহ্নও পাওয়া গেছে। চীনা সম্রাট ফু-সি ও হলুদ সম্রাট হুয়াংদি বলেছিলেন, “ইন ও ইয়াং নীতি সমগ্র মহাবিশ্বের মূল। জীবন ও মৃত্যুর উৎস।”

অর্থাৎ, সৃষ্টির “দ্বৈত” ধারণা বা “জোড়া” ভাবনা কোরআনের নয় — বরং মানুষের প্রাচীন দর্শন ও পর্যবেক্ষণ থেকেই এসেছে। এই ক্রেডিট যদি কাউকে দিতে হয়, তা চীনাদেরই প্রাপ্য। চীনারাও তো দাবী করতে পারে আধুনিক বিজ্ঞান যা এখন জানতে পারছে তা তারা জেনেছেন ২ হাজারেরও বেশি বছর আগে। তাহলে তাদের ধর্মই একমাত্র সত্য ধর্ম।

অনেককেই বলতে শুনি অল্প বিদ্যা ভয়ংকর, কোরানের সমালোচনা করতে হলে নাকি আরো অনেক জ্ঞান অর্জন করতে হবে। আপনাদের কাছে প্রশ্ন কোরানের লেখক যদি এতই জ্ঞানী হতেন তাহলে কোরানে এতো এতো ভুল কেন? কোরান যদি মহাবিশ্বের একমাত্র সৃষ্টীকর্তা আল্লাহর পাঠানো বাণী হয়ে থাকে- তাহলে তো সেই আল্লাহর ব্রাহমিনি ব্লাইন্ড স্নেক সম্পর্কে জানার কথা, কমোডো ড্রগন সম্পর্কে জানার কথা, জানার কথা সেই মাকড়সার সেই প্রজাতির সম্পর্কে যাদের ভেতর কোন স্ত্রী মাকড়সাই নেই। ইসলামের বিশ্বাস অনুযায়ী আল্লাহই তো এসমস্ত প্রাণীদের সৃষ্টী করেছেন। কোরান লেখার সময় আল্লাহ এইসব প্রানী আর তাদের প্রজনন পদ্ধতি সম্পর্কে ভুলে গেলেন কিভাবে? নাকি আল্লাহর নাম ব্যবহার করে অন্য কেউ কোরান লিখেছে? যাইহোক যেই কোরান লিখুক তার যে জীবজগৎ সম্পর্কে ধারণার অভাব ছিলো সেটা পরিষ্কার বোঝা যায়।

সুতরাং এটা স্পষ্ট যে কোরানে বর্ণিত ‘জোড়ায় জোড়ায়’ সৃষ্টির বিষয়টা বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল। এরকম অসংখ্য বৈজ্ঞানিক ভুল কোরানে আছে।

লেখক : নাফিস সাদিক শাতিল

ব্লগার ও এক্টিভিস্ট

Writer : Nafis Sadique Shatil

© নাফিস সাদিক শাতিল/ NAFIS SADIQUE SHATIL

এই ক্যাটাগরির আরো ব্লগপোস্ট পড়তে এখানে ক্লিক করুন

Tags :

Recent News

Popular News

Find Us on Youtube