ইসলামের মূল গ্রন্থ কোরআনে বৈজ্ঞানিক ভুলের পাশাপাশি রয়েছে গাণিতিক ভুলও। বিশেষ করে উত্তরাধিকার আইনে এই ভুলটি স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। কোরআনের বিধান অনুযায়ী যখন সম্পত্তি ভাগ করার কথা বলা হয়, তখন প্রত্যেক উত্তরাধিকারীর জন্য নির্দিষ্ট ভগ্নাংশ উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, এই ভগ্নাংশগুলো অনেক সময় যোগ করলে মোট সম্পত্তির চেয়ে বেশি হয়ে যায়।
অর্থাৎ, সম্পূর্ণ সম্পত্তি ১০০ ভাগের সমান হলেও ভাগগুলো যোগ করলে তা ১০০-এর বেশি হয়ে দাঁড়ায়। একজন সাধারণ গণিত জানেন এমন মানুষের পক্ষেও এই ধরনের ভুল মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। যখন কোন সম্পত্তি ভাগ করা হয়, তখন ভগ্নাংশগুলোর যোগফল অবশ্যই ১ এর সমান হতে হবে। এর বেশি বা কম হলে পুরো সম্পত্তি সঠিকভাবে ভাগ করা সম্ভব হবে না। অথচ কোরআনের সম্পত্তি বন্টনের বিধানগুলোতে এই সহজ নিয়মটাই মানা হয়নি। ফলে পরিষ্কার বোঝা যায়, এটি কোনো অলৌকিক জ্ঞানের ফল নয়, বরং সে সময়ের মানুষের সীমিত জ্ঞানের প্রতিফলন।
কোরআনের ৪ নম্বর সূরা অর্থাৎ সূরা নিসার ১১ ও ১২ নম্বর আয়াতে মুসলিম পরিবারে ওয়ারেশদের ভেতর সম্পত্তি বন্টনের নিয়ম কানুন বর্ণনা করা হয়েছে।
আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে আদেশ করেনঃ একজন পুরুষের অংশ দু’জন নারীর অংশের সমান। অতঃপর যদি শুধু নারীই হয় দু`এর অধিক, তবে তাদের জন্যে ঐ মালের তিন ভাগের দুই ভাগ যা ত্যাগ করে মরে এবং যদি একজনই হয়, তবে তার জন্যে অর্ধেক। মৃতের পিতা-মাতার মধ্য থেকে প্রত্যেকের জন্যে ত্যাজ্য সম্পত্তির ছয় ভাগের এক ভাগ, যদি মৃতের সন্তান থাকে। যদি সন্তান না থাকে এবং পিতা-মাতাই ওয়ারিস হয়, তবে মাতা পাবে তিন ভাগের এক ভাগ। অতঃপর যদি মৃতের কয়েকজন ভাই থাকে, তবে তার মাতা পাবে ছয় ভাগের এক ভাগ ওছিয়্যতের পর, যা করে মরেছে কিংবা ঋণ পরিশোধের পর। তোমাদের পিতা ও পুত্রের মধ্যে কে তোমাদের জন্যে অধিক উপকারী তোমরা জান না। এটা আল্লাহ কতৃক নির্ধারিত অংশ নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, রহস্যবিদ। (কুরআন-৪:১১)
আর, তোমাদের হবে অর্ধেক সম্পত্তি, যা ছেড়ে যায় তোমাদের স্ত্রীরা যদি তাদের কোন সন্তান না থাকে। যদি তাদের সন্তান থাকে, তবে তোমাদের হবে এক-চতুর্থাংশ ঐ সম্পত্তির, যা তারা ছেড়ে যায়; ওছিয়্যতের পর, যা তারা করে এবং ঋণ পরিশোধের পর। স্ত্রীদের জন্যে এক-চতুর্থাংশ হবে ঐ সম্পত্তির, যা তোমরা ছেড়ে যাও যদি তোমাদের কোন সন্তান না থাকে। আর যদি তোমাদের সন্তান থাকে, তবে তাদের জন্যে হবে ঐ সম্পত্তির আট ভাগের এক ভাগ, যা তোমরা ছেড়ে যাও ওছিয়্যতের পর, যা তোমরা কর এবং ঋণ পরিশোধের পর। যে পুরুষের, ত্যাজ্য সম্পত্তি, তার যদি পিতা-পুত্র কিংবা স্ত্রী না থাকে এবং এই মৃতের এক ভাই কিংবা এক বোন থাকে, তবে উভয়ের প্রত্যেকে ছয়-ভাগের এক পাবে। আর যদি ততোধিক থাকে, তবে তারা এক তৃতীয়াংশ অংশীদার হবে ওছিয়্যতের পর, যা করা হয় অথবা ঋণের পর এমতাবস্থায় যে, অপরের ক্ষতি না করে। এ বিধান আল্লাহর। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সহনশীল।
(কুরআন-৪:১২)
এই দুই আয়াত ইসলামে সম্পত্তি বণ্টনের মৌলিক ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়। এখন একটি বাস্তব উদাহরণ ধরা যাক। ধরে নিই, আনিসুর রহমান নামের এক ব্যক্তি মারা গেলেন। তার পরিবারে রয়েছেন বৃদ্ধ পিতা-মাতা, স্ত্রী ও তিন কন্যা। হিসাবের সুবিধার্থে ধরে নিচ্ছি তিনি রেখে গেছেন ১০০ টাকা। এখন কোরানের হিসাব অনুযায়ী ভাগ করলে— পিতা-মাতা প্রত্যেকে পাবেন ৬ ভাগের ১ ভাগ করে, অর্থাৎ ১৬.৬৬ টাকা। দুজন মিলে পাবেন ৩৩.৩৩ টাকা। তিন কন্যা মিলে পাবে মোট সম্পত্তির ৩ ভাগের ২ ভাগ, অর্থাৎ ৬৬.৬৭ টাকা। স্ত্রী পাবেন ৮ ভাগের ১ ভাগ, অর্থাৎ ১২.৫০ টাকা। এখন হিসাব করলে দেখা যায়, পিতা মাতা, তিন কন্যা স্ত্রী মিলে মোট ভাগ দাঁড়ালো ১১২ টাকা ৫০ পয়সা। অথচ আনিসুর রহমান রেখে গেছেন মাত্র ১০০ টাকা। তাহলে এই বাড়তি ১২ টাকা ৫০ পয়সা কোথা থেকে আসবে?
অর্থাৎ কোরানের হিসাব অনুযায়ী আনিস সাহেব যদি ১ কোটি টাকার সম্পদ রেখে যান, তাহলে কোরানের আইনে ভাগ করলে তার ওয়ারিশরা পাবে মোট ১ কোটি ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকার সম্পদ। তাহলে অতিরিক্ত ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকা আসবে কোথা থেকে? কে দিবে এই টাকা?
আবার ধরা যাক আনিসুর রহমান ২৪ ডেসিমেল বা ২৪ শতাংশ জমিও রেখে গেছেন। এখানে কোরান অনুযায়ী ভাগ করলে তার ৩ কন্যা পাবে মোট সম্পত্তির ৩ ভাগের ২ ভাগ অর্থাৎ ১৬ শতাংশ, পিতামাতা দুজনে মিলে পাবেন ৮ শতাংশ, স্ত্রী পাবেন ৩ শতাংশ। অর্থাৎ তিন কন্যা, পিতামাতা স্ত্রী মিলে পাবেন ২৭ শতাংশ জমি। কিন্তু আনিসুর রহমান রেখে গিয়েছেন ২৪ শতাংশ জমি। তাহলে বাদবাকি ৩ শতাংশ জমি আসবে কোথা থেকে?
কোরানের গাণিতিক ভুলের আরেকটি উদাহরণ দেখা যাক। মনোয়ারা বেগম মারা গেলেন, রেখে গেলেন ১৫ লক্ষ টাকা। ওয়ারিশ আছেন এক কন্যা, পিতা-মাতা ও স্বামী। কোরানের আইন অনুযায়ী হিসাব করলে পাওয়া যায়, কন্যা পাবে অর্ধেক: সাড়ে সাত লাখ টাকা। মনোয়ারার মা পাবেন ৬ ভাগের ১ ভাগ অর্থাৎ আড়াই লক্ষ টাকা। মনোয়ারার পিতাও পাবেন ৬ ভাগের ১ ভাগ অর্থাৎ আড়াই লক্ষ টাকা। তার স্বামী পাবেন ৪ ভাগের ১ ভাগ মানে ৩ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা। এগুলো যোগ করলে হয় ১৬ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা। অথচ মনোয়ারা বেগম মৃত্যুকালে রেখে গিয়েছেন ১৫ লক্ষ টাকা। বাকি ১ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা আসবে কোথা থেকে? আসমান থেকে?
এই সমস্যা ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর ইবনে খাত্তাবের শাসনামলে তীব্র হয়ে ওঠে। সে সময় এক নারী মারা গেলেন, রেখে গেলেন স্বামী ও দুই বোন। নিয়ম অনুযায়ী স্বামী পাবেন অর্ধেক, আর দুই বোন পাবেন দুই-তৃতীয়াংশ। কিন্তু এই হিসেবটি সমস্যার সৃষ্টি করল। যদি স্বামীকে সম্পত্তির অর্ধেক দেয়া হয়, তবে দুই বোনের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ বাকি থাকবে না, আর যদি দুই বোনকে তাদের অংশ দেয়া হয়, তবে স্বামীকে তার প্রাপ্য মোট সম্পদের অর্ধেক অংশ সম্পূর্ণভাবে দেয়া সম্ভব হবে না। খলিফা উমর এই সমস্যা সমাধানের জন্য সাহাবিদের সাথে পরামর্শ করেন। অনেক সাহাবি প্রস্তাব দিলেন—“আউল” নামক একটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হোক। এর মানে হলো, যাদের যেটা নির্ধারিত অংশ আছে, তাদের প্রত্যেকের অংশ সমানভাবে কমিয়ে দেওয়া। অর্থাৎ স্বামীর প্রাপ্য এক-অর্ধাংশ এবং দুই বোনের প্রাপ্য দুই-তৃতীয়াংশ সমানভাবে কমিয়ে সকলের মধ্যে বণ্টন করা হলো।
কিন্তু বিখ্যাত সাহাবি ইবনে আব্বাস এর বিরোধিতা করেন। তিনি বললেন, “এটি আল্লাহর নির্ধারিত ভাগের বিরোধিতা। কোরআনের বিধান পরিবর্তন করা যাবে না।” আসলে এটাই সত্য কোরানের উত্তরাধিকার আইনের আয়াতগুলোতে রয়েছে গাণিতিক ভুল। এই ভুল রেখে কখনোই জমির সঠিক বন্টন সম্ভব নয়। আবার আল্লাহর তৈরী বিধানের পরিবর্তন ঘটানোটা স্বয়ং আল্লাহর সাথে বিরোধীতার শামিল। তবুও বাস্তবতা মেনে নিয়ে উমরের এই ভুল সংশোধন করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিলোনা। তিনি প্রথমবারের মতো ‘আউল’-এর নিয়ম প্রবর্তন করলেন। পরবর্তীতে চারটি সুন্নি মাযহাবও এটিকে গ্রহণ করে।
তবে আউল নীতি অনুযায়ী জমির বন্টনে কোরানের আইনের প্রতিফলন ঘটেনা। যেমন আনিসুর রহমান মারা যাওয়ার পর কোরান অনুযায়ী ৩ কন্যার পাওয়ার কথা ১৬ শতাংশ, আওল অনুযায়ী পাবে ১৪.২২ শতাংশ। যা কোরানের আইনের সাথে কোনভাবে মিলেনা। আবার জাকির নায়েকসহ অনেক বক্তা নিজেদের মনগড়া দাবী থেকে বলেন প্রথমে নাকি স্বামী বা স্ত্রীর অংশ দিতে হবে। তারপর পিতামাতার। এরপর অবশিষ্ট অংশ ভাগ করা হবে সন্তান ও অন্যান্য ওয়ারিশদের ভেতর। তবে জাকির নায়েকের এই হিসাবও কোরানের আইনের সাথে সাংঘর্ষিক। এতে করেও কিছু উত্তরাধিকার তাদের প্রাপ্য অংশ থেকে বঞ্চিত হবে।
খলিফা উমর বা জাকির নায়েক কারো পক্ষেই কোরানের এই গাণিতিক ত্রুটিসম্পন্ন আয়াতকে সঠিক ধরে সম্পদের বন্টন করা সম্ভব নয়। পরবর্তীতে কোরানের আইন সংশোধন করে তৈরী করা কোন আইনই কোরানের আইনের সাথে মিলবেনা। উমর বুঝতে পেরেছিলেন কোরানের ঐ আয়াতগুলোতে গাণিতিক ভুল বা অসংগতি আছে। তাই তিনি এই আইনকে সংশোধন করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
ধরুন আব্দুল কুদ্দুস মারা গেলেন তার ১ কন্যা রেখে। আব্দুল কুদ্দুসের কোন ভাই বোন নেই। তার মা স্ত্রী কেউই জীবিত নেই। মৃত্যুকালে তিনি রেখে গিয়েছেন ১০ শতাংশ জমি। কোরানের আইন অনুযায়ী তার কন্যা পাবে তার রেখে যাওয়া সম্পত্তির অর্ধেক। তাহলে বাকি অর্ধেক কে পাবে? তার তো তিনকূলে কেউ নেই। তাহলে বাদবাকি সম্পত্তির ওয়ারেশ কে হবে? এই সমস্যার সমাধানে নতুন এক নীতির উদ্ভব ঘটানো হয় যাকে বলা হয় রাদ নীতি। রাদ নীতি অনুযায়ী বাদবাকি অর্ধেক অংশও কন্যা পাবে। কিন্তু কোরানে তো বলা হয়েছে একজন কন্যা থাকলে সেই কন্যা পাবে মোট সম্পত্তির অর্ধেক। এক কন্যা যখন পুরো সম্পত্তি পায়, সেটা তো স্পষ্টই আল্লাহর আইনের বিরুদ্ধে যায়। তাহলে কোরানের আইন লঙ্ঘন করে সম্পূর্ণ সম্পত্তি কেন কন্যা পাবে?
কারণ খুবই পরিষ্কার। উত্তরাধিকার সংক্রান্ত কোরানের আইনটা ত্রুটিপূর্ণ। এই ত্রুটি রেখে ওয়ারেশদের ভেতর সঠিকভাবে বন্টন অসম্ভব। সম্পত্তি ভাগাভাগির পর কখনো বন্টনকৃত সম্পদ মোট সম্পদের বেশি হয়ে যায়, আবার কখনো কম হয়ে যায়। কোরানে এই গাণিতিক ত্রুটি বুঝতে পেরেই এসব আওল রাদ নীতি চালু করা হয়েছে।
ধরুন আপনার কাছে ৫ টি কিংবা ৭ টি আম আছে। আপনাকে বলা হলো আমগুলো ৬ জনের মাঝে এমনভাবে বন্টন করতে যেনো সবাই একটি করে আম পায়। কোরানের উত্তরাধিকার আইন কিছুটা এরকমই।
মুমিন ভাইয়েরা দাবী করে কোরানের বিধান নাকি কিয়ামত পর্যন্ত একই থাকবে। কিন্তু তারা নিজেরাই কোরানের আইনকে সংস্কার করে তৈরী করা আইন মেনে চলছে শত শত বছর ধরে। আসলে এছাড়া তাদের আর করারই বা কি আছে? কোরানের আয়াতে যদি গাণিতিক ত্রুটি থাকে সেই দোষ তো আর তাদের নয়। প্রশ্ন হলো নির্ভুল কিতাব কোরানে কেন গাণিতিক ত্রুটি থাকবে? কেন সেটা মানুষের সংশোধনের প্রয়োজন পড়বে?
ইসলামের বিশ্বাস অনুযায়ী কোরানকে মনে করা হয় আসমানী কিতাব, সর্বজ্ঞানী আল্লাহর বাণী। কিন্তু কোন সর্বজ্ঞানী নিখুঁত সত্ত্বার পক্ষে কি এরকম গাণিতিক ভুল করা সম্ভব?
লেখকঃ নাফিস সাদিক শাতিল
ব্লগার ও এক্টিভিস্ট
© নাফিস সাদিক শাতিল/ NAFIS SADIQUE SHATIL
পড়ুনঃ কোরানের আয়াত নিয়ে সংশয়


